সড়কে সংকেত মানার বালাই নেই, ভরসা হাতের ইশারা

Passenger Voice    |    ০৪:৫১ পিএম, ২০২১-১০-২১


সড়কে সংকেত মানার বালাই নেই, ভরসা হাতের ইশারা

সড়কে বাধ্যতামূলক, সতর্কতামূলক, তথ্যমূলক এই তিন ধরনের চিহ্ন রয়েছে মোটরযান আইনে। তিন ধরনের চিহ্নের মধ্যে দেড়শ’রও বেশি চিহ্ন বা সংকেত রয়েছে সড়কে। আইনে এত সংকেতের কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে চোখে পড়ে খুব কমই। ফলে সড়কে চলাচলের জন্য সংকেতগুলো যানবাহনের চালক, পথচারীদের জানা ও মানার জন্য যে আগ্রহ থাকার কথা সেটিও চোখে পড়ে না।

আবার সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল নির্দেশক যেসব চিহ্ন ও যন্ত্র রয়েছে তার অধিকাংশই অকেজো। অবহেলা আর অযত্নে যেন সবই পড়ে আছে পরিত্যক্ত হয়ে। নেই কোনো ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা। সড়কের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা চলে শুধু পুলিশের হাতের ইশারা ও চালক, পথচারীর ইচ্ছায়। এছাড়া সড়ক আইন মানতে সচেতনতার জন্য নেই কোনো প্রচারণাও। অথচ গত দুই দশকে ‘ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট’ প্রকল্পসহ শুধু বিশ্বব্যাংকই ট্রাফিক সিগন্যাল লাইট ও ব্যবস্থাপনায় প্রায় ১২৭ কোটি টাকার সহায়তায় দেয়। এ দুই দশকে সরকারও এ খাতে প্রায় শত কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।

মোটরযান আইনে মোটর যান প্রবেশ নিষেধ, রিকশা প্রবেশ নিষেধ, পশুটানা গাড়ি প্রবেশ নিষেধ, হাতে ঠেলা গাড়ি প্রবেশ নিষেধ এমন ৪০টি বাধ্যতামূলক সংকেত রয়েছে সড়কে। বিপজ্জনক সড়ক, রক্ষিত বা অরক্ষিত রেল সড়ক এমন ৬০টি সতর্কতামূলক সংকেতসহ হালকা জলযোগ বা টি-স্টল, সার্ভিস স্টেশন, রেস্ট হাউজ বা রাত্রি নিবাস, টেলিফোন সেন্টার এমন ৩৭টি তথ্যমূলক সংকেত রয়েছে সড়কে। রয়েছে ট্রাফিক সংকেতসহ আরও বেশকিছু সংকেতও। এতো সব চিহ্নের মধ্যে বাস্তবে সড়কে দৃশ্যমান মাত্র ৩০-৪০টি সংকেত। গুটিকয়েক চিহ্ন ছাড়া অধিকাংশ বিপজ্জনক ও সতর্কতা সংকেত নিয়ে চালকদের কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। পথচারীরাও রাস্তা পার হন নির্ধারিত কোনো সংকেত ছাড়াই।

গত কয়েকদিন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ ট্রাফিক সিগন্যালই অকেজো। কোনোটা আবার ফুটপাতের দোকানে ঢেকে গেছে। কোনোটা বাঁকা হয়ে আছে। সতর্কতার জন্যও যেসব চিহ্ন রয়েছে তার কোনোটা মুছে গেছে, কোনোটার ওপর আবার ঝুলছে নানা ফেস্টুন। কোনোটা ফেস্টুনে গেছে ডেকে। দেখে বোঝারই উপায় নেই ট্রাফিক সিগন্যাল রয়েছে স্থানটিতে। আবার কোথাও দেখা যায়, সংকেত বা লেখা নির্দেশক খুঁটিগুলো থাকলেও মানা হচ্ছে না সেসব নির্দেশনা। গাড়ি পার্কিং নিষেধ লেখা থাকলেও সেখানে গাড়ি পার্কিং করে রাখা, হর্ন বাজানো নিষেধ লেখা থাকলেও বাজানো হচ্ছে হর্ন। এমন নানা বিধিনিষেধ থাকলেও তা মানছেন না পথচারীসহ বাস, প্রাইভেটকার ও রিকশাচালকরা।

রাজধানীর নগর ভবনের সামনে গিয়ে দেখা যায়, পার্কিং নিষেধ লেখা থাকলেও সরকারি গাড়ি পার্কিং করে রাখা আছে। রামপুরা-বাড্ডা রোডে দেখা যায়, গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা না থাকলেও গাড়ি নিয়ে বসে আছেন কয়েকজন চালক। সেখানে কথা হয় প্রাইভেটকারচালক আব্দুর রাজ্জাকের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সড়কে সাইন নাই, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নাই। সব গাড়ি রাস্তায় দাঁড়ানো ছাড়া উপায় কী? আশপাশে পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থা নাই বলেই এখানে পার্কিং করেছি। ভয়ে আছি কখন সার্জেন্ট এসে মামলা দিয়ে দেয়।

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ তে ট্রাফিক সাইন ও সংকেতের ব্যবহার নিয়ে ধারা ৪২ (১) এ বলা আছে, সরকার বা সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান মোটরযানের গতিসীমা, ওজন, পার্কিং ও চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং সড়ক নিরাপত্তা বিধানকল্পে সড়ক, মহাসড়ক বা পাবলিক প্লেসে ট্রাফিক সাইন স্থাপন, প্রতিস্থাপন বা অপসারণ করতে পারবে এবং কোনো সংকেত উত্তোলন বা প্রদর্শন করতে পারবে। অথচ গত কয়েকদিন রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, পার্কিং, সড়ক নিরাপত্তা বিধানকল্পে ট্রাফিক সাইন স্থাপন, প্রতিস্থাপন বা অপসারণের তেমন ব্যবস্থা নেই। ট্রাফিক সাইন স্থাপন, প্রতিস্থাপন বা অপসারণের কথা থাকলেও বিকল হয়ে যাওয়া সিগন্যালগুলো প্রতিস্থাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এই চিত্র নগরীর ব্যস্ততম গুলিস্তানসহ অধিকাংশ স্থানেই দেখা যায়।

রিকশাচালকরাও মানেন না কোনো সংকেত। রিকশাচালক মো. আজিজুলের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, পেটের দায়ে রিকশা নিয়ে বের হই। আইন-টাইন কী আছে জানি না। লোক তুলি ভাড়া মারি। সিগন্যালগুলো তো দেখি না তেমন। পুলিশ সিগন্যাল দিলে মোড়গুলোতে থামাই, কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভাড়া নিয়ে চলে যাই। এর বাইরে আর কিছু জানি না।

সিগন্যাল মানানোর বিষয়ে ট্রাফিক সার্জেন্ট জাফর ইমাম বলেন, ট্রাফিক সিগন্যালের কোনো কিছুই সচল নেই। এতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে আমাদের সমস্যা হয়। হাত দিয়ে সিগন্যাল দিতে হয়। রিকশাচালকদের ট্রাফিক আইন নিয়ে বেশি সমস্যায় পড়ি। আইন নিয়ে তাদের ধারণাও নেই, শিক্ষাও নেই। শাস্তি দিতে গেলে আবার অমানবিক হয়ে যায়। অথচ সংকেত না মেনে মূল সড়কে উঠে ১০-১৫ কি.মি. গতির একটি রিকশা যখন ৩০-৫০ কি.মি. গতির একটি বাসের সামনে চলে আসে তখন বাসের গতিটি কমে যায়, জ্যামের সৃষ্টি হয়। বাসচালকরাও কোথায় থামতে হবে, প্রাইভেটকারগুলো কোথায় পার্কিং করতে হবে এসব কোনোটাই মানে না।

সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪২ এর (২) বলা আছে, প্রত্যেক মোটরযান চালক, পথচারী বা সড়ক ব্যবহারকারী ট্রাফিক সাইন, সংকেত ইত্যাদি মেনে চলবে। কিন্তু ট্রাফিক সাইন, সংকেত সচল না থাকায় অধিকাংশ স্থানেই ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায় চলছে যানবাহন। সড়কের মোড়গুলোতে এইভাবে চললেও বাকি কোথাও সেই শৃঙ্খলাও নেই। এ বিষয়ে কথা হয় বাসচালক মো. সুহেলের সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, সংকেতই ঠিক নাই কী দেখে চলবো? ট্রাফিকেরও কোনো ব্যবস্থা নাই। ক্যান্টনমেন্ট আর গুলশান এরিয়ার মতো হলে সবই ভালো চলতো। এখন শুধু প্রতিযোগিতা চলে। এসব সাইন দেখার সময় কারও নাই। সবার টাকা ইনকামের দিকে নজর।

ট্রাফিক সাইন, সংকেত না থাকায় বিপাকে পড়েন খোদ ট্রাফিক সার্জেন্টরাই। এ বিষয়ে কথা হলে জাতীয় ঈদগা মোড়ে দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক সার্জেন্ট মো. রোকনুজ্জামান বলেন, সিগন্যালগুলো না থাকায় সব ম্যানুয়ালি করতে হয়। এতে কষ্ট হয় আমাদের। প্রায়ই গাড়িগুলো আটকানোর সময় সিগন্যাল পার হতে গিয়ে হাতে ধাক্কা মেরে চলে যায়। আমাদের কিছু করার নেই। সিগন্যালগুলো সচল থাকলে আমাদের জন্য সড়কে শৃঙ্খলা রাখা আরও সহজ হতো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও উপ-মহাপুলিশ পরিদর্শক মো. মুনিবুর রহমান বলেন, অটো সিগন্যালগুলোর ব্যবস্থাপনা সিটি করপোরেশন দেখেন। এসব ব্যবস্থাপনার জন্য যে বাজেট ও লোকবল দরকার সেটা নেই। আবার এগুলো যেহেতু ইলেকট্রনিক বিষয়, নষ্ট বা খারাপ হলে নিয়মিত ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে ব্যবস্থাপনা করা হয়ে ওঠে না। ফলে অকেজো হয়েই পড়ে থাকে, ভালো আর হয় না।

তিনি বলেন, ২০১৯ সালে অটোমেশন সিগন্যাল চালু হয়েছিল। ঢাকা শহরের একেক এলাকায় একেক ধরনের ট্রাফিক চলাচলের জন্য এটি অব্যাহত থাকেনি। একেক দিন একেক ধরনের গাড়ি চলাচল হয়, একক সময়ে একেক একেক ধরনের চাপ থাকে গাড়ির। ফলে একটি একক সিগন্যাল সিস্টেমে না চালাতে পাড়ায় সিস্টেমটি বিকল হয়ে গেছে, সফল হয়নি।

প্রত্যেক সড়ক ব্যবহারকারীকে সড়ক বা মহাসড়ক পারাপারে নির্দিষ্ট জেব্রা ক্রসিং, ফুটওভার ব্রিজ, আন্ডারপাস বা অনুরূপ সুবিধার কথা থাকলেও নেই কোনো সঠিক ব্যবস্থাপনা। রাস্তা পারাপারে পথচারীরা মানছেন না নির্ধারিত কোনো স্থান বা সিগন্যাল। মাঝ রাস্তাতেই খালি পেয়ে কিংবা চলন্ত গাড়ির ফাঁকেই পার হন লোকজন। রাস্তা পার হতে দেখে বাড্ডার লিংক রোডে এমনই এক পথচারীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই পথচারী বলেন, কাজের তাড়া আছে তাই এইদিক দিয়েই পার হয়েছি। এখানে পথচারী পারাপারের ব্যবস্থা থাকলে পার হতাম না।

এদিকে, সড়ক আইন, চলাচল ও সংকেত মানতে সচেতনতার জন্য নেই তেমন কোনো প্রচারণা। সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগও তেমন চোখে পড়ে না বলে জানান অনেকে। পথচারী মো. আশরাফুল ইসলাম জানান, মাঝে মাঝে খুঁটি দেখি। সিগন্যাল কাজ করে না। এসব নিয়মও তেমন জানি না। তাই মানাও হয় না। নিজেদের মতোই চলি। এগুলোর জন্য আসলে কিছু প্রচারণা চালানো উচিত।

চালক, পথচারীসহ মানুষের মাঝে সচেতনতার জন্য কী করছেন জানতে চাইলে মো. মুনিবুর রহমান বলেন, আমরা সমন্বিতভাবে কাজ করছি প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে নিয়ে। সবাই কাজ করলে সচেতনতাসহ পুরো ট্রাফিক ব্যবস্থা ও সিগন্যালগুলোকে আবার সচল করা সম্ভব। ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা ও নীতিমালা করলে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে সড়কের ব্যবস্থাপনা ফিরে আসবে আশা করি।

সূত্র: জাগো নিউজ